প্রাণ-প্রকৃতি ও কৃষির জন্য অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা ও প্রণোদনা দাবি

একমঞ্চে ছয় কৃষি প্রতিবেশের বিশেষজ্ঞদের অভিমত

নিজস্ব প্রতিবেদক :

রাজশাহীতে দেশের ছয়টি কৃষি প্রতিবেদেশের মানুষ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জাতীয় সবুজ সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশে ভিন্ন ভিন্ন এলাকার কৃষকেরা তাদের নিজ নিজ এলাকার সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। এসব সমস্যার সমাধানে তারা প্রাণ-প্রকৃতি ও কৃষির জন্য অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোর দেন। দাবি করেন, আলাদা আলাদা প্রণোদনাও।

প্রাণ-প্রকৃতি, কৃষি প্রতিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষায় সোমবার দিনভর রাজশাহীতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি মিলনায়তনে এই সমাবেশের আয়োজন করে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক, সবুজ সংহতি ও বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরাম। অনুষ্ঠানের শুরুতে সকালে একটি বর্নাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রায় নানা স্লোগানে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অংশ নেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।

মাটির ধরন, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রাসহ অন্যান্য বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে ৩০টি কৃষি প্রতিবেশ এলাকায় ভাগ করা হয়েছে। এই উপাদানগুলোকে বৃহত্তর পরিসরে বিবেচনা করলে বাংলাদেশকে ছয়টি প্রতিবেশ অঞ্চলে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে আছে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেটের কিছু অংশ নিয়ে পাহাড়িয়া অঞ্চল, বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন উপকুলীয় অঞ্চল, সমতল প্লাবন ভূমি, চর অঞ্চল, বিল ও হাওড় বেষ্টিত জলাভূমি অঞ্চল এবং খরাপ্রবন বরেন্দ্র অঞ্চল। দিনভর এ আয়োজনে পাহাড়ি, উপকূলীয়, প্লাবন ভূমি ও বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকেরা অংশগ্রহণ করেন।

অনুষ্ঠানের প্রথম অধিবেশনে চারটি গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। জলবায়ু সংকট ও তরুণদের নগর সংস্কার; প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রাম ও সকট; কৃষকের অধিকার, পেনশন ও ভর্তুকি এবং জেন্ডার নায্যতা বিষয়ক গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় অধিবেশনে সবুজ সংহতি, পরিবেশ ন্যয় বিচারবিষয়ক আলোচনা এবং পরিবেশ আইন ও অধিকার বিষয়ক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব গণশুনানি, সেমিনার ও আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারীরা তাদের মতামত তুলে ধরেন।

বক্তারা বলেন, দেশের প্রতিটি অঞ্চলের আলাদা আলাদা বৈচিত্র্য রয়েছে। এই বৈচিত্র্যকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এ সকল অঞ্চলের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি। তাই দেশের স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নে প্রতিটি ভৌগোলিক অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রাণবৈচিত্র্যসহ বহুজাতির গোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের সামগ্রীক স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নে তাই প্রয়োজন অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা। প্রাণ প্রকৃতি, কৃষি প্রতিবেশ ও আঞ্চলিক ভৌগোলিক পরিবেশ ধ্বংস হলে মানুষ নানামূখী সংকটে পড়বে।

তারা বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে দিনে দিনে খরা এবং পানির সংকট ভয়বহ আকার ধারণ করছে, যার কারণে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। তেমনি জলাভূমি হাওড় অঞ্চলে আগের তুলনায় বন্যা এবং জলাবদ্ধতা বেড়েছে, আবার উপকুলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়েছে, চরাঞ্চলে নদীভাঙ্গন বেড়েছে। পাহাড়ের বৈচিত্র্য আগের তুলনায় কমেছে। অন্যদিকে উন্নয়নে স্থানীয় প্রাকৃতিক এবং প্রাণ সম্পদকে গুরুত্ব না দিয়ে বা প্রকৃতিভিত্তিক ও সম্পদ ভিত্তিক সমাধান না খুঁজে যখন অনেক বেশি রাসায়নিক সার, বিষ-কীটনাশক বাহির থেকে আমদানি নির্ভর হয়, তখন এদিকে আমাদের নিজস্ব বীজ সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদগুলো হারিয়ে যায় বা ধ্বংস হয়ে যায়। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশ, কৃষিপ্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করা এবং জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অঞ্চলভিত্তিক আলাদা নীতিমালা ও পরিকল্পনা ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্বে অংশ নেন বিশিষ্ট প্রাণিবিজ্ঞানী অধ্যাপক বিধান চন্দ্র দাস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান কাজী রবিউল আলম, সহযোগী অধ্যাপক অভিজিৎ রয়, লেখক, গবেষক ও বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ, নৃবিজ্ঞানী সৈয়দ আলী বিশ্বাস, নগর গবেষক জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ।

বক্তব্য রাখেন- জাতীয় সবুজ সংহতি সমাবেশের আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক আতিকুর রহমান আতিক, নৃবিজ্ঞানী শহিদুল ইসলাম, সাতক্ষীরার যুব প্রতিনিধি ইসরাফিল ইসলাম, শ্যামনগরের কৃষক গোবিন্দ মন্ডল, গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব, নেত্রকোণার কৃষক সায়েদ আহমেদ খান বাচ্চু, মানিকগঞ্জের কৃষক মনোয়ার হোসেন, রাজশাহীর চিচিলিয়া হেমব্রম, বিলকিস বেগম, জাহিদুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ জামাল কাদেরী, পরিবেশ আন্দোলনকর্মী শাহনেওয়াজ সৈকত, আহাদুল সিরাজ, শাইখ তাসনীম জামাল প্রমুখ।

সবুজ সংহতি সমাবেশ উপলক্ষে একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়। প্রদর্শনীতে ছয়টি কৃষি প্রতিবেশের নানা কৃষিপণ্যের বীজ, শাক-সবজি ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র স্থান পায়। এছাড়া মৌর্য আমল থেকে ব্রিটিশ ভারতের শাসনকাল পর্যন্ত সময়ের মুদ্রাও ছিল। সেখানে স্বর্ণমুদ্রা দেখতে দর্শনার্থীদের বিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে।

সংশ্লিষ্ট খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button