ডিসি’র স্বাক্ষর জালিয়াতি করেও বহালে অভিযুক্ত অধ্যক্ষ

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর দূর্গাপুরের একটি টেকনিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ জেলা প্রশাসক সহ সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে কলেজের গভর্নিং বডি’র অনুমোদন দেখান ৷ পরে বহাল কমিটির একজন শিক্ষানুরাগী সদস্য ভুয়া স্বাক্ষর করে এই কমিটি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে ইউএনও বরাবর অভিযোগ দেন ৷ ইউএনও অভিযোগ আমলে নিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। জেলা প্রশাসকের স্বাক্ষর জাল প্রমানিত হয়েছে বলে তারা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। কিন্তু জেলা প্রশাসকের স্বাক্ষর জালিয়াতি প্রমান হলেও অধ্যক্ষের এখনও স্ব-পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন । এখন ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয়দের প্রশ্ন, কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না ? কোন অদৃশ্য শক্তির বলে অধ্যক্ষ এখনও বহাল আছেন ?
সূত্র বলছে, গত ৮ অক্টোবর-২৪ বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের স্মারক নং ৫৭.১৭.০০০০.৪০২.৩৭.০৭২.২৪.৩৩৪৭/১৫৪ এর এক অফিস আদেশে পলাশবাড়ী আদর্শ টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের গভর্নিং বডি’র কমিটি অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ ওঠে ঐ স্মারক নম্বর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের নয়, নীচে স্বাক্ষর করা পরিদর্শক ও উপপরিদর্শকের স্বাক্ষরও আসল নয়। কমিটিতে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক কর্তৃক মনোনিত শিক্ষানুরাগী সদস্য মো: আনারুল ইসলাম। কিন্তু জেলা প্রশাসক এই মনোনয়ন দেননি অর্থাৎ তার স্বাক্ষর জাল করেই এটা করা হয়েছে। কলেজের প্রিন্সিপাল মাইনুল ইসলাম এসকল জাল জালিয়াতির মূল হোতা বলে দাবি করেন বহাল কমিটির শিক্ষানুরাগী সদস্য হায়াত আলী। তিনি প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগে কলেজের শিক্ষানুরাগী সদস্য হায়াত আলী বলেন, অধ্যক্ষ মাইনুল ইসলাম স্বাক্ষর জালিয়াতি ও দূর্নীতির মাস্টার নামেই পরিচিত। তার বিরুদ্ধে পাহাড় সম অভিযোগ। তার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার  স্বাক্ষর জালিয়াতি, প্রতারণা, নকল সার্টিফিকেট বিক্রি, কলেজের খেলার মাঠ দখল, উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ, জেলা পরিষদ কর্তৃক অনুদানের অর্থ আত্বসাত, রশিদ বিহীন লেনদেন ও ঘুষ দিয়ে চাকরি দেয়া, প্রতিষ্ঠানে নিজ পরিবারের সদস্যদের চাকরি দেয়া এবং চাকরি দেয়ার নাম করে টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে। দীর্ঘ (১৭) সতের বছর কোন নিয়মনীতি, আইনের তোয়াক্কা না করে সীমাহীন দূর্নীতি ও অনিয়ম করেছেন তিনি। তার স্ত্রী কলেজের সহঃ অধ্যাপিকা আরজান্নেসা দীর্ঘ ১১ বছর অনুপস্থিত থেকে নিয়মিত বেতন উত্তোলন করেছেন আবার প্রমোশনও পেয়েছেন।। অত্র কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে টাইম স্কেল বাবদ ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে নেন। ৪ বছর পার হলেও তারা এখনো তাদের কোন টাইম স্কেল পাই নাই। এসব বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে চরম ক্ষোভবিরাজ করছে। তারা একাধিকবার এসব বিষয়ে অত্র কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলে সুরাহা পান নাই বরং তারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। কলেজের কম্পিউটার প্রদর্শক জাহাঙ্গীর আলমের টাইম স্কেল সংযুক্ত হয় এমপিও (মান্থলি পেটেন্ট অর্ডার) নভেম্বর ২০১৮ সালে। কিন্তু অধ্যক্ষের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় অতিরিক্ত প্রাপ্য উত্তোলন করতে দেয়া হয়নি। ৩ মাস পর ২ লক্ষ টাকায় সমঝোতার ভিত্তিতে মার্চ ২০১৯ সালে অতিরিক্ত টাকা উত্তোলন করা হয়। তার কাছে ১০০ টির বেশী সিম আছে। এগুলো কলেজের বিভিন্ন শিক্ষক, কর্মচারীদের ও নানান নামে সিম কিনে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা হাতিয়ে নেন তিনি৷ চাকরি দেয়ার নামে পলাশবাড়ী গ্রামের মালু মোহাম্মদদের ছেলে লাল মোহাম্মদ’র কাছ থেকে ১০ বছর আগে ৫ লক্ষ নেন। এখন পর্যন্ত তাকে চাকরি দেয়া হয়নি আবার টাকাও ফেরত দেননি। তিনি তৎকালীন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রভাব দেখিয়ে বিভিন্ন মানুষকে নানাভাবে হয়রানি ও হুমকি দিতেন। চাকরিপ্রার্থী শেফালী বেগম এবং তার বাবা আইনুদ্দিনের কাছ থেকে কলেজের জমি দাতা হিসেবে স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি করে নেন এবং কলেজের মাঠ দখল করে আম বাগান তৈরি করেন। পলাশবাড়ী গ্রামের সমজান আলীর কাছ থেকে চাকরি দেয়ার নামে ১০ লক্ষ টাকা নেন। কিন্তু তাকেও কোন চাকরি দেয়া হয়নি। তার বিরুদ্ধে রয়েছে সার্টিফিকেট বিক্রির অভিযোগও। পলাশবাড়ী গ্রামের জনৈক ব্যক্তির কাছে ডিগ্রী সমমান ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট ২ লক্ষ টাকায় বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে পাহাড় সমান সম্পদ গড়েছেন। হাট-গোদা গাড়ি বাজারে ১২ কাঠা জমিতে মার্কেট, কলেজের মাঠে ১৬ কাঠা জমির আম বাগান, রাজশাহী শিরোইল কলোনি ৪ নং গলি ছোট মসজিদ সংলগ্ন অটো গ্যারেজসহ ৮ কাঠা জমির ওপর বাড়ি এবং পলাশবাড়ী গ্রামে ধানী জমি ও পুকুর। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা শারমিন বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দুলাল আলম এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নুর এ শেফা’কে। তারা বিষয়টি তদন্তের জন্য ৩ ফেব্রুয়ারী-২৫ প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত সকলের সাক্ষ্য ও প্রমানাদী সংগ্রহ করেন এবং  অধ্যক্ষকে ৭ ( সাত) কর্ম দিবসের মধ্যে কারন দর্শানোর নোটিশ দেন। কিন্তু ৩ মাসের মধ্যেও তিনি কোন উত্তর দেননি। অবশেষে ২৭ এপ্রিল-২৫ তদন্ত কর্মকর্তার রিপোর্টে স্বাক্ষর জালিয়াতিসহ তার অনিয়ম ও দূর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসে। স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়টি প্রমানিত হয়। উপজেলা সম্মেলন কক্ষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা শারমিন মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার দুলাল আলম, একাডেমি সুপারভাইজার মাইদুল, ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি মোঃ মোস্তাকিন, জেলা প্রসাশক মনোনীত প্রতিনিধি আনারুল ও শিক্ষক কর্মচারীর সম্মুখে অকপটে জেলা প্রসাশকের স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়টি স্বীকার করেন।
কলেজ পরিচালনা কমিটির  একাধিক সদস্য বলেন,  এ অধ্যক্ষ কলেজে দূর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। তার বিরুদ্ধে  শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহনে সবাই একমত। কিন্তু সভাপতি কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। তাদের অভিমত, অধ্যক্ষের এসব অনিয়ম,দূর্নীতির সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও জড়িত।
অভিযুক্ত অধ্যক্ষ মাইনুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে আনিত সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা বলে বিস্তারিত আর কোন কথা বলতে রাজী হননি।
এ বিষয়ে দূর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা শারমিন বলেন, তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। তদন্ত হয়েছে, সেগুলো প্রমাণও হয়েছে। জেলা প্রশাসক স্যারকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের স্বাক্ষর উনি জালিয়াতি করেছেন, সেটা তিনি স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক দপ্তর থেকে তাকে শোকজ করা হয়েছে। এখন আরও একটা তদন্ত চলছে।

সংশ্লিষ্ট খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button