রাজশাহী আঞ্চলিক হাঁস-মুরগী; দুগ্ধ ও গবাদি পশু, ছাগল উন্নয়ন খামারে খাদ্য সরবরাহের আড়ালে সরকারি অর্থ লুটপাটের অভিযোগ

আনিসুজ্জামান : রাজশাহী আঞ্চলিক হাঁস-মুরগী খামার, দুগ্ধ ও গবাদি পশু উন্নয়ন খামার এবং সরকারি ছাগল উন্নয়ন খামারের খাদ্য সরবরাহে আড়ালে সরকারি অর্থ লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। খামারের কতিপয় শীর্ষ কর্মকর্তার যোগসাজশে হাতেগোনা ২-৩ জন ঠিকাদারের সিন্ডিকেট টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে ঠিকাদার সিন্ডিকেটে জিম্মি হয়ে পড়েছে উল্লিখিত পশু খাদ্য কেনাকাটা। ফলে ঘুরেফিরে তারাই বার বার কাজ পাচ্ছে। এছাড়া সর্বনিম্ন দরদাতার পরিবর্তে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যোগসাজস ও দুর্র্নীতির অভিযোগ এনে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকে লিখিত দেওয়া হয়েছে। এদিকে টেন্ডারে নতুন শর্ত দিয়ে দুর্র্নীতির অভিযোগে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন সংক্ষুব্ধ একজন ঠিকাদার। সর্বশেষ অর্ধকোটি টাকার খাদ্য ও ওষুধ ক্রয়ের টেন্ডারেও নতুন শর্ত দিয়ে সিন্ডিকেটের কব্জায় নেয়ার তৎপরতার অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়িহাটে অবস্থিত সরকারি দুগ্ধ ও গবাদি পশু উন্নয়ন খামারে খাদ্য উপকরণ সরবরাহে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে দীর্ঘদিন ধরে। কয়েকজন ঠিকাদার কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে বার বার কাজ পাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে খাদ্য উপকরণ সরবরাহের জিআর-১ গ্রুপের দরপত্রে (নং-৬৮২৯৯৮) সর্বনিম্ন দরদাতা ‘রজব অ্যান্ড ব্রাদার্স’ ৭৮ লাখ ৯৭ হাজার ৬৬০ টাকা দর দেয়। একই কাজ ৮৬ লাখ ৪৯ হাজার ৪৫ টাকা দর দেয় ‘মেসার্স করিম ট্রেডার্স’। তবে কর্তৃপক্ষ সাড়ে সাত লাখ টাকা বেশি প্রদানকারী সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেয়।
সূত্র মতে, জিআর-৩ দরপত্রে (নং-৮৫২১২২) ধানের খড়, ভুট্টা, ছোলা, ভিটামিন মিনারের প্রিমিক্স (ডিবি) ও আয়োডিন লবন সরবরাহে ‘মেসার্স সদর অ্যান্ড ব্রাদার্স’ ৩৯ লাখ ৭১ হাজার ৩৫৪ টাকা দর দেয়। একই কাজে সর্বোচ্চ দরদাতা ‘এইচএন এন্টারপ্রাইজ’কে ৬৭ লাখ ৮৭ হাজার ৪৭৩ টাকায় কাজটি দেয়। এতে সরকারের ২৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা ক্ষতি হয়।
অন্যদিকে গবাদি পশু উন্নয়ন খামারে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে গমের ভূষি ও টেক্সিন বাউন্ডার সরবরাহের টেন্ডারে (জিআর-১, নং ৮২৫৪০৬) বেটাগা ট্রেডার্স ১ কোটি ৬ লাখ ৬০ হাজার ৬৮৩ টাকা দর দেয়। একই কাজে মেসার্স করিম ট্রেডার্স টেন্ডারে দর দেয় ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬৭ হাজার ৬৪০ টাকা। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ৩০ লাখ ৬ হাজার ৯৫৬ টাকা বেশি দরদাতাকে কাজ দেয়।
অভিযোগ উঠেছে, আইন ও নিয়মের ফাঁক গলিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও স্থানীয় শীর্ষ কর্মকর্তারা সরকারি অর্থ তছরূপ করছেন। কেবল জিআর-১ ও জিআর-৩ এর খাদ্য সরবরাহের দরপত্রেই অর্ধকোটি টাকার বেশি লোপাটের বিষয়ে সম্প্রতি দুদকে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। তবে মেসার্স করিম ট্রেডার্সের মালিক রবিউল করিম বলেন, গরুর খামারে খাদ্য সরবরাহের একটি, মুরগীর খামারের ও ছাগলের খামারের দু’টি কাজ তিনি পেয়েছেন। শুধু টেন্ডারে অংশ নিয়েই কাজ পাওয়া যায় না। শর্তানুযায়ী কাগজপত্র থাকতে হয়। এখানে কোনো অনিয়ম হয় নি’।
দুদকের রাজশাহী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আমির হোসাইন বলেন, ‘অভিযোগটি অনুসন্ধানের অনুমতির জন্য ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে’।
এদিকে সম্প্রতি মুরগীর খামারে খাদ্য সররবাহে তিনটি গ্রুপে প্রায় সোয়া কোটি টাকার টেন্ডারে টেন্ডারে নতুন শর্তারোপ করায় সিন্ডিকেটের বাইরের ঠিকাদারেরা অংশ নিতে পারেনি। কর্তৃপক্ষের এমন আচরণে ঠিকাদার সদর উদ্দিন সংক্ষুব্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন। হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চের বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এসএম মাসুদ হোসেন আগামী ২৯ জুলাই রিটের শুনানি তারিখ ধার্য করেছেন। রিটকারী সদর উদ্দিন বলেন, কয়েক বছর ধরে তিনি খাদ্য সরবরাহ করছেন। কিন্তু এবার নতুন শর্তারোপ করায় তার মতো অনেকে অংশ নিতে পারেননি। ফলে কর্তৃপক্ষের পছন্দের ঠিকাদার টেন্ডার ড্রপ করেছেন। এটাও দুর্নীতি। প্রচলিত আইনের বাইরে কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এ কারণে আমি আদালতে গিয়েছি।
সর্বশেষ গত ৯ জুন সরকারি ছাগল উন্নয়ন খামারের খাদ্য সরবরাহের প্রায় ৪৫ টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে জিআর-১ গ্রুপে সয়াবিন খৈল, ছোলা, ভুট্টা ও ওষুধ প্রিমিক্স ডিবি এবং জিআর-২ গ্রুপে গমের ভূষি, খেসারির খোসা ও ওষুধ ডিপি সরবরাহের দরপত্র দাখিলের শেষ দিন ২৪ জুন। ঠিকাদারদের অভিযোগ, এতোদিন ওষুধ আলাদা টেন্ডারে কেনা হতো। কিন্তু এবার পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে খাদ্যের সাথেই ওষুধ সরবরাহের বিষয়টি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী মেসার্স রিফাত ট্রেডার্সের মালিক আবুল কাশেম বলেন, ‘আগে খাদ্যের টেন্ডার আলাদা হতো। কিন্তু এবার একসাথে টেন্ডার করা হয়েছে। টেন্ডারের নতুন শর্তানুযায়ী ওষুধ সরবরাহে পছন্দের সিন্ডিকেট ছাড়া বাকিদের যোগ্যতা নেই। টেন্ডারের নামে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা চতুরতার সাথে কাজটি করেছেন। ফলে চলমান ঠিকাদারেরা টেন্ডার দিতে পারছেন না। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এই লুটপাটের প্রতিকার চান তারা।
তবে সংক্ষুব্ধ ঠিাকাদারদের অভিযোগ অস্বীকার করে ছাগল উন্নয়ন খামারের উপ-পরিচালক ডা. আতিকুর রহমান দাবি করেন, ‘নিয়মের বাইরে কোনো কিছুই করা হয় না। আমার একা কিছু করার সুযোগও নেই। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি বসে সিদ্ধান্ত দেয়। আর দুদকে অভিযোগ ও হাইকোর্টে রিটের বিষয়টি তার জানা নেই’। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) ড. এবিএম খালেদুজ্জামান বলেন, ‘ই-জিপি নীতিমালা অনুযায়ী টেন্ডার হয়। তবে কেউ লিখিত অভিযোগ করলে আমরা তদন্ত করবো। হাইকোর্ট বা দুদক ডাকলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জবাব দেবেন’।